#মা_আমার_জামা_চাই_না,_তোমাকে_চাই
জান্নাতুল_ফেরদৌসী_জেমি




রাত পেরোলেই ঈদের দিন। বিশ্বের সকল মুসলিম ভাই-বোনদের খুশির উৎসব। সবাই নতুন জামাকাপড় পড়বে।

ঈদের এই আগের দিনে সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় রহিমা বেগম। গতবছর যখন রোজার আগে তার স্বামী মারা যায়, তখন তার মেয়ে রেসমার বয়স ছিলো মাত্র ৫বছর।  স্বামী মারা যাওয়ার কয়েকদিন পরেই শ্বশুর বাড়ি থেকে রহিমা বেগম কে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। বাপের বাড়িতেও তেমন কেউ নেই যে সেখানে গিয়ে উঠবে। বাবা-মা তো সেই কবেই মরে গেছে, থাকার মধ্যে আছে এক ছোট ভাই। কিন্তু দুই সন্তান নিয়ে তাদের চারজনের খাবার জোগাতে সে হিমসিম খায়। সেখানে কি আর যাওয়া চলে!
রহিমা বেগম একমাত্র মেয়ে রেসমা কে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। চেনা নেই জানা নেই একটা নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশে আসে সে। কতরকম মানুষ এই শহরে, ভালো খারাপ মিশ্রিত। কাউকে দেখে বোঝার উপায় নেই কার মনে কি আছে।
ঢাকায় এসে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকে মেয়েকে নিয়ে। এর মাঝে সে এক বাসাবাড়িতে কাজ পেয়ে যায়। মেয়েকে নিয়ে সেখানেই ওঠে।  বেশকিছু দিন ভালোই যায়। তবে কিছুদিন পর বাসার মালিকের খারাপ ব্যবহারে রহিমা বেগম বাধ্য হয় কাজ ছাড়তে। তখন তাদের থাকার জায়গা হয় কমলাপুর রেলস্টেশনের পাশে ছোট্ট এক কুঁড়েঘর। সেবার ঈদ চলে আসে, ছোট মেয়ে কি আর কিছু বোঝে। নতুন জামার জন্য কান্না করতে থাকে। কিন্তু এই শহরে চেনা কেউ নেই যে রহিমা বেগম তার কাছে সাহায্য চাইবে৷ তিনি ভীষণ অসহায়। মেয়েকে পরের ঈদে জামা কিনে দিবে এই আশায় সান্ত্বনা দেয়। মেয়ে হাসিমুখে মায়ের কথা মেনে নেয়।

এবারও ঈদ চলে এসেছে কিন্তু রহিমা বেগম পারেনি মেয়েকে দেওয়া কথা রাখতে, মেয়ের জন্য নতুন জামার ব্যবস্থা করতে।

দেশের অবস্থা দিন দিন অবনতির দিকে। করোনার ভয়াবহতা যেন বেড়েই চলেছে। সামাজিক যোগাযোগ কমে গেছে, বন্ধ হয়ে গেছে অনেকের কাজকর্ম।  এর মাঝে রহিমা বেগমও আছে। করোনার কারণে তাকে কাজ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। জমানো টাকাপয়সা যা ছিলো তাই দিয়ে মা মেয়ের দিন যাচ্ছিলো এতোদিন। কিন্তু এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। পেটের দায়ে হাত পাততে হয় অন্যের দ্বারে দ্বারে। এর মাঝেই ঈদ চলে আসে। রহিমা বেগমের বুকের মধ্যে এক হাহাকার কাজ করে, যেন জমে আছে এক বুক শূন্যতা।
তাই সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়৷ যদি মেয়ের জন্য  একটা জামার ব্যবস্থা করতে পারে এই ভেবে।
সারাদিন কেটে যায়, রহিমা বেগম বাড়ি ফেরে না। এদিকে মা কে কাছে না পেয়ে কান্নায় অবিরাম কান্নারত রেসমা। মা কখনো তাকে এভাবে একা ফেলে কোথাও যায় নি। আজকেই প্রথম মা তাকে রেখে কোথাও চলে গেছে। রেসমার যেন কান্না থামেই না।
সন্ধ্যা গড়িয়ে এলে বাড়ি ফিরে আসে রহিমা বেগম। চোখেমুখে ফুটে ওঠেছে না পাওয়ার বেদনা, যেন মেয়ের কাছে বড্ড অপরাধী।

মা কে দেখে দৌড়ে আসে রেসমা। জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না!
মা তুমি কোথায় গেছিলে, কেনো গেছিলে?  আমায় নেও নি কেনো? ইত্যাদি প্রশ্নে মা কে জর্জরিত করতে থাকে ছোট্ট রেসমা।
রহিমা বেগম কান্না জড়িত কন্ঠে বলে ওঠে, মা রে আমি এবারও পারি নি তোর জন্য নতুন জামা আনতে। পারি নি তোকে দেওয়া কথা রাখতে।
বলেই কাঁদতে থাকে মা মেয়ে দুজনেই।
রেসমা তখন কান্না থামিয়ে সেই ছোট ছোট হাতে পায়ের চোখের পানি মুছে দিতে থাকে। আর বলে, মা আমার জামা চাই না, আমার তোমাকে চাই। তুমি হলেই আমার হবে, আমার জামা চাই না।
ছোট্ট মেয়ের এমন কথা শুনে আনন্দে ভরে ওঠে রহিমা বেগমের মন। মা মেয়ে দুজন দুজনকে জড়িয়ে এক অদ্ভুত প্রশান্তিময় কান্নায় ভেঙে পড়ে।


সমাপ্ত